বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ০৯:০১ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
সিদ্ধিরগঞ্জে কিশোরগ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক শফিকের বিরুদ্ধে ১৫ সংগঠনের বিবৃতি নারায়ণগঞ্জে এনটিভির ২২ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত বক্তৃতা করে কখনো কোনো আন্দোলন সফল হয়নি: গয়েশ্বর আ’লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় সন্ত্রাসীদের ফাঁসির দাবিতে যুবলীগের মিছিল আওয়ামী লীগ নেতা সুরুজ মিয়া হত্যাকাণ্ডের মুল আসামিসহ গ্রেপ্তার ৪ সরকারী হাসপাতাল উপজেলা পর্যায়ে সাপের বিষ নিধনে এন্টিভেনম রয়েছে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জের মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র পরিদর্শনে উপ-সচিব যেখানেই থাকো না কেনো সেখানে সফল হওয়ার স্কোপ আছে: ড. আসিফ নজরুল কাঞ্চন পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী বাদশার প্রচার-প্রচারণায় গণজোয়ার স্ত্রীর মামলায় মাকসুদ চেয়ারম্যান কারাগারে

“তুমি টাকা দিবা কই থাইক্কা”

মীর আব্দুল আলীম
  • Update Time : বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২৩
  • ১৩৯ Time View

আমার গ্রামের ছোট বেলার পল্লী চিকিৎসক। নাম ‘টুকুন ডাক্তার। তিনিও এখন আর বেঁচে নেই। বছর ৪০ আগে মারা গেছেন। রাজধানী ঢাকার পাশে তখনকার সময়ের নিভৃত পল্লীতে বসেই চিকিৎসা সেবা দিতেন গ্রাম্য চিকিৎসক টুকুন ডাক্তার। তিনি সে সময়কার আমার গ্রামের একমাত্র ডাক্তার। চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসা। অসম্ভব মেধাবী এই চিকিৎসকের চিকিৎসাপদ্ধতি ছিল একটু ভিন্ন ধরনের, একেবারে সাদাসিধে জীবনযাপন ছিল তাঁর। শোয়ার ঘরটিও টিনের বাংলো ঘরের মতো ছিল। সামান্য সময় পেলেই বসে যেতেন পড়ার টেবিলে। বই-সেই চিকিৎসা সাস্ত্রীয়। ডাক্তারিত ওপর সংসার চলত তার। গোটা গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করলেও তার অভাবের সংসারই ছিল। টুকুন ডাক্তার তার আসল নাম নয়। তবে এ নামেই তিনি পরিচিত ছিলন। এ নামের ভিড়ে আসল নামটি যেন হারিয়ে গেছে কখন। যখন লিখছি, তখন আমার পিতার কাছে ছুটে যাই টুকুন ডাক্তারের আসল নাম জানতে। তিনিও বলতে পারলেন না। সরলভাবে বললেন- “নাম তো টুকুন ডাক্তারই। পরে তার ছোট ছেলের কাছ থেকে জানা গেলো তার প্রকৃত নাম আবদুল আজিজ। চিকিৎসা করে সকলের কাছ থেকেই টাকা পয়সা নিতেন না তিনি। অভাবি মানুষদের বলতেন- “তুমি টাকা দিবা কই থাইক্কা।’ তার সংসারের অভাবটাও বুঝতে দিতেন না রোগীদের। এই ছিলো আগেকার চিকিৎসকের মনোভাব। এখন বদলে গেছে সব। কোনকোন ডাক্তারকেতো এখন কষাই বলা হয়। এখনও টুকুন ডাত্তারের মতো মানবীক চিকৎসক অনেক আছেন, তবে সংখ্যায় তা খুব কম।

এখন চিকিৎসা সেবায় কি চলছে? টুকুন ডাক্তারদের মতো মানবিক চিকিৎসক কমে গেছে। সারাদেশে সরকারি, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন কোনো শেষ নেই। অনেক ক্লিনিকেতো রীতিমতো অচিকিৎসকরাই রোগীদের চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। অথচ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদফতরের বড় বড় কর্মকর্তা যেন ‘নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়। দেশের ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর অবস্থাতো আরও ভয়াবহ। রোগ পরীক্ষার নামে এদের বেশির ভাগই মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে, রোগীদের প্রকারন্তরে হত্যা করছে। এ রকম হৃদয়বিদারক ঘটনা অহরহ ঘটছে। কারণ বেশিরভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রশিক্ষিত লোকজন বা টেকনিশিয়ান নেই বললেই চলে। পরীক্ষায় যেসব উপাদান ব্যবহার করা প্রয়োজন, তা করা হয় না। আবার অনেকে খরচ কমাতে মেয়াদোত্তীর্ণ উপাদান ব্যবহার করে। দু’টি হাসপাতালের মালিক হিসাবে দীর্ঘ ১৬ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি অনেকেই হাসপাতালের বিধি নিষেধ মানেন না। এসব সেন্টারে আগে থেকে প্যাথলজির একজন অধ্যাপকের সই করা রেজাল্ট সিট থাকে, সে যা খুশি লিখে রোগীর স্বজনদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। আমরা জানি না, আর কত নিচে নামব আমরা? নীতি-নৈতিকতাহীন ব্যবসার কাছে মানুষ আর কতকাল অসহায় হয়ে থাকবে? আর কত নিষ্ঠুরতা আমাদের দেখতে হবে? রাষ্ট্রের কাছে আমরা এর প্রতিকার চাই। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে যেন ব্যবসার নামে লাগামহীন কর্মকান্ড না চলে, তার নিশ্চয়তা চাই।

যা বলছিলাম, ঢাকার পাশের রূপগঞ্জের রূপসী গ্রামের এই টুকুন ডাক্তারে উপরেই আমাদের গোটা গ্রামের চিকিৎসা সেবা নির্ভর ছিল। আমার ভাগ্নে এ হাই মিলন। বর্তমানে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। আমার বছর খানেকের ছোট হবেন তিনি। সেই ছোট বেলায় কাঁচা বাঁশ দিয়ে ভোঁ ভোঁ করে গাড়ি চালাতে গিয়ে নিজের অজান্তেই আমার থুতনিতেই বাঁশ লাগিয়ে দিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে কেটে ঝুলে গেলো থুতনীর মাংস। সবাই ধরা ধরি করে ৬ বছর বয়সী আমাকে নিয়ে গেলেন টুকুন ডাক্তারের কাছে। একটু ডেটল, একটু ব্যান্ডেজ আর কয়েকটি ওষুধ নিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। বললেন- ‘বাড়িত যাইয়া সাগু খাওগা, দুই চারদিন পরে সাইরা যাইবো।’ তাই হয়েছে। সেই আমারই বড় ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় সামান্য ব্যথা পেয়ে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের কেবিনে ২২ দিন এবং পরে তিনি যে মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন সে মেডিকেল কলেজে ৩ মাস ভর্তি ছিলেন। সামান্য পায়ের আঘাতেই তার ৬ মাস লেগে গেছে সুস্থ হতে।

আসলে আমরা নিজেরাই যেন কেন দিন দিন জটিল হয়ে যাচ্ছি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়ন হয়েছে। অবনতি হয়েছে আমাদের। আমাদের চিকিৎসকরা অনেকে দিনকে দিন জটিল হচ্ছেন, বাণিজ্যিক হচ্ছেন (তবে সবাই না)। ছোট বেলায় জ্বর হলে মা জোর করে সাগু খাইয়ে দিতেন। সাগু খাওয়ার ভয়েই দৌড়ে পালাত জ্বর। তা না হলে বড় জোেড় ডাকা হতো টুকুন ডাক্তারকে। তিনি যে দোকানে বসে চিকিৎসা দিতেন তার আশপাশের পথঘাটগুলো মান্ধাতা আমলের ছিল। সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটু কাদা। তখন ছিল না ওই গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থাও। ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় রাত বিরাতে অন্ধকারেই ছুটতেন টুকুন ডাক্তার। তিনি মিক্চার কিংবা দু’একটা বড়ি খাইয়ে দিলেই জ্বর-জারি হাওয়ায় মিলাত। আর হাঁচি কাশি তো তিনি তুড়ি দিয়েই সারিয়ে দিতেন। এখন আছেন কি সেই ভদ্র, সজ্জন, বিনয়ী, ত্যাগী ও মানব দরদী কোন টুকুন ডাক্তার? এখনকার ডাক্তারগন সেবা দেন না তা বলছি না। বললে যে আমার ঘারেই পড়বে বেশি। কারণ আমার পরিবারেই ডজন খানেক ডাক্তার আছেন। ডাক্তারগণ এখন বড্ড বেশি প্রফেশনাল, এটা আমাকে বলতেই হবে। হাসপাতালগুলো তো বটেই!

আল-রাফি হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসাবে আমাকে নারায়ণগঞ্জ জেলার হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্ট করা হয়। উপদেষ্টা হিসেবে স্থানীয় তিন এমপি গাজী গোলাম দস্তগীর (বীরপ্রতীক), নজরুল ইসলাম বাবু, এবং লিয়াকত হোসেনও রয়েছেন। আমরা হাসপাতাল মালিকদের নিয়ে যখন আলোচনায় বসি তখন একটি কথাই আমি আমার বক্তব্যে বলি, হাসাপাতাল ব্যবসা বলবেন না। এটা চিকিৎসা সেবা। সম্প্রতি আল-বারাকা হাসপাতালে সমিতির সাধারণ সভায় অতিথি হিসেবে ছিলাম। সবাইকে একটি গল্প শুনিয়েছি। আমার গল্প তো সব বাস্তব ঘটনা নিয়ে। বাস্তব ঘটনাকে গল্প বলি, এ কারণে যে আমাদের চাওয়া পাওয়াগুলো বাস্তবে রূপ পায় কম। গল্পের মতো মিলিয়ে যায় সব। নাটক সিনেমা শেষ হলে যা হয় তাই। মনে রাখে না কেউ। বাস্তবে রূপ পায় না।

কয়েক দিন আগের কথা। রাতে একজন মোবাইলে ফোন করে বলছেন- ‘স্যার আপনার হাসপাতালের আমার নাতি হইছে। বার বার কইছি সিজার করতে। করে নাই। নরমাল ডেলিভারির করণে আমার মাইয়ার অনেক ক্ষতি হইয়া গেছে।’ কি ক্ষতি জানতে চাইলাম আমি। বললেন, বিশেষ স্থানে সেলাই করা হয়েছে তাতে সমস্যা হচ্ছে। বললাম অপরাধীতো আমি নিজেই। হাসপাতালে সোজাসুজি বলে দিয়েছি অপারেশন তো দূরের কথা অহেতুক একটি ইনজেকশনও কারও গায়ে পুশ করা যাবে না। আপনারা অপরেশন চাইলেও আমরা প্রথম নরমাল প্রসবের চেষ্টা করি। হয়ত তারা তাই করেছেন। বললাম, একটি অপারেশন এত সহজ কথা নয়। তাতে সারা জীবনের প্রতিক্রিয়া থাকে। আরও বললাম অপারেশন করে দিলেই তো কয়েক হাজার টাকা পেতাম আমরা। জানতে চাইলাম হাসপাতালে কত টাকা দিয়েছেন। ১ হাজার টাকা। বললাম টাকাও বেঁচে গেছে, আপনার মেয়েও একটা অপারেশন থেকে রক্ষা পেয়েছে। বললাম আগামী কাল ৪টায় চলে আসেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের গাইনির বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে বলে রাখব- আপনার মেয়ের সমস্যাটা যেন ভালোভাবে দেখেন। এও বললাম আমাদের অপরাধের জন্য যদি প্লাস্টিক সার্জারির প্রয়োজন লাগে তা করে দেব আমরা। পরে চিকিৎসা শেষে ঔষধেই যখন সুস্থ্য হয়ে যান তখন ওই ব্যক্তি এবং তার মেয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। বলেছি এটা আমাদের কর্তব্য। আমরা অহেতুক অপারেশনে বিশ্বাসী নই। মানুষ তো আমরা? কয়েক হাজার টাকার জন্য অহেতুক পেট কেটে কাউকে কষ্ট দিতে রতে চাই না আমরা। চিকিৎসা যেন সেবার জায়গায়ই থাকে, সে কথাই সেদিনের সভায় নারায়ণগঞ্জের হাসপাতালের মালিক, ডাক্তার সবাইকে বললাম।

রাগঢাক না রেখে বলতেই হয় দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে ভয়াবহ নৈরাজ্য চলছে। সরকারি বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা নিয়ম-নীতি মানেন না। সরকারি হাসপাতালে চলে দুর্নীতি আর বেসরকারি হাসপাতালে চলছে শুধুই বাণিজ্য। চিকিৎসাসেবার নামে যার যা খুশি তাই করছে। পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন রোগীরা। সরকারি হাসপাতালগুলোতে বেসরকারি ওষুধ কোম্পানিগুলোর এজেন্টদের আধিপত্য ও দাপটে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়। তারপরও দেখার কেউ নেই। সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের দেখার পরিবর্তে ডাক্তাররা নিজেরাই দলাদলি নিয়ে বেশি ব্যস্ত। প্রায় সবাই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন বিভিন্ন ক্লিনিকে। এ কারণে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকরা নিজেরাই রোগীদের বলেন, এখানে ভালো অব¯’া নেই। আপনারা অমুক ক্লিনিকে চলে যান। সেখানে আমি নিজেই দেখে দিতে পারব। অসহায় রোগীরা ডাক্তারদের সে কথাই শোনেন। হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা পরিবেশের অবস্থাও খারাপ। টয়লেটগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার লোকবলের অভাব। অনেক হাসপাতালে রয়েছে ডাক্তার ও নার্সের সংকট। ডাক্তাররা উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে থাকতে চান না। মনিটরিংয়ের অভাব সবখানে। সরকারি বেশির ভাগ হাসপাতাল সিন্ডিকেট এবং দলবাজদের দখলে। রয়েছে ওষুধ বাণিজ্যের সিন্ডিকেট। ডাক্তারদের ফি নেওয়ার রেট নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। চিকিৎসকরা ই”ছা মাফিক বেট নেন। পাঁচ তারকা হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার যতবার রোগী দেখতে আসবে ততবারই মোটা অঙ্কের ফি দিতে হবে। অন্যান্য ফি তো রয়েছেই। এদিকে দরিদ্র, অসহায় রোগীদের জিম্মি করে হাতুড়ে ডাক্তাররা চিকিৎসার নামে প্রতারিত করছে সাধারণ মানুষকে। এতে দাঁতের রোগীরা দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আক্রান্ত হন। দেখার কেউ নেই। একজন গরিবের যখন হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ বড় রোগ আক্রান্ত হন তখন তাকে ঘরবাড়ি বিক্রি করে চিকিৎসা করাতে হয়। অনেক ডাক্তার সেই সুযোগটা নিতে চান। তারা রোগীকে মানুষ মনে করেন না।

মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে চিকিৎসা হলো অন্যতম একটি অধিকার। স্বাস্থ্য সেবায় আমাদের দেশে অনেক নিয়ম ও নীতি আছে, কিন্তু জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা কোথাও নেই। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আরও নেই। এক ধরনের জুলুমতন্ত্র কায়েম হয়েছে হাসপাতালগুলোতে। আর এ জন্য সর্বস্বান্ত হতে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের। এভাবে তো চলে না? চিকিৎসকদের একটু মানবিক হওয়া উচিৎ।

লেখক : মহাসচিব- কলামিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ,
চেয়ারপার্সন (পরিবেশ)- লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল (৩১৫ এ-১)।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
Translate »