২৮ অক্টোবর কি হবে!সংঘাত হবে? রক্ত ঝড়বএ? লাশ পড়বে? জ্বালাও পোড়াও, ভাংচুর হবে?উল্টাসিদা কথাবার্তায় অনেকটা রণসাজেইতো দেখছি সরকার এবং বিরোধী দলকে। আমরা সংঘাত চাই না; শান্তি চাই। তবেরাজনৈতির কথার হুঙ্কার চারদিকে! খেলা হবে, তাও নাকি ফাইনাল খেলা। সরকারে দায়িত্বশীলরাই এমন হুঙ্কার দিচ্ছেন। এমন ঘোষণায় জনমনে আতংক তৈরি হয়েছে বৈকি? কেবল বাংলাদেশে নয়, বহিবিশ্বে ২৮ তারিখকে ঘিরে না জল্পনাকল্পনা চলছে। চলছে জদাজিদির রাজনীতি ।
এর আগে ১০ ডিসেম্বরসহ তারিখ ভিত্তিক অনেক রাজনৈতিক কর্মসূচি দেখেছি আমরা,তখন আতংকও তৈরি হয়েছে অনেক। সেসব কথিত তারিখে এই হবে, সেই হবে। পরে কিছুই হয়নি। কিছু একটা হবে হয়তো তবে ২৮ তারিখে নয়। বেশ বোঝা যাচ্ছে ১৪ কিংবা ১৮ সালের কায়দায় আগের নির্বাচন হবে না। আমেরিকা নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যেভাবে প্রকাশ্যে এসেছে তাতে দ্বাদশ নির্বাচনী রূপ বদলাতে পারে।
কোন দলকেই এখন ছিাট ভাবার সুযোগ নেই। বহিবিশে^র চাপের কারনে আওয়ামী লীগকে শক্তিহীন ভাবা যেমন বিএনপির বোকামি, তেমনি বিএনপিরও জনসমর্থন নেই ভাবলে আওয়ামী লীগও চরম ভুল করবে। বিএনপি তারিখ টার্গেট করে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করেছে। এদিকে বিএনপিকে মোকাবিলার জন্য নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।সরকারদল নেতারা বলেছেন, আগামী ২৮ অক্টোবর নিয়ে বিএনপি যে স্বপ্ন দেখছে সেই স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিতে হবে। ঢাকা শহর থাকবে জয় বাংলার দখলে।এদিকে একই দিনে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি নিয়ে অনড় অবস্থান থাকায় সংঘাত-সহিংসতার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।দু-দলের মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে ২৮ অক্টোবর। এদিন নির্ধারণ হতে পারে দেশের রাজনীতি ও আন্দোলন-সংগ্রামের গতিপথ। ফলে এখন পর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের সংঘাত-সহিংসতা না হলেও ২৮ অক্টোবর থেকে দেশের রাজনীতিতে আরও উত্তাপ্ত ছড়াতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
আবার রাজনীতির মাঠে উত্তেজনা; সংঘাত-সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে হুঙ্কার দিচ্ছে তাতে করে সামনে আরও ভয়াবহ দিন আসছে মনে হয়। আবারও অশান্তির দিকেই ফিরছে দেশ। দেশের মানুষ আর সংঘাত-সংঘর্ষ চায় না। দেশের মানুষ শান্তি চায়: রাজনৈতিক বিবাদ চায় না। হরতাল, অবরোধ, ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও চায় না। উন্নয়ন ব্যাহত হোক চায় না। অর্থনৈতিক চাকা অচল হোক চায় না। জনগণ ভোটাধিকার চায়, গণতন্ত্র চায়, একটু শান্তি চায়। এজন্য সংলাপের বিকল্প নেই। সফল সংলাপ হলে সংঘাত হবে না। আর তাই হোক এটাই প্রত্যাশা দেশবাসীর।
এদেশে গণতন্ত্রের চর্চা আমরা খুব একটা দেখিনি। আজও দেশে গণতন্ত্রের যে চর্চা হচ্ছে তা কোনভাবে বলা যাবে না। আমরা জামায়াত-বিএনপি, জাতীয় পার্টির আমলেও কমবেশি একই রূপ দেখেছি। অস্ত্রের রাজনীতি, ক্ষমতার রাজানীতি প্রয়োগে সবাই সমান। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার দেশাত্মবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, মানসিকতা, অব্যাহত চর্চা, অনুশীলন কারও মধ্যে নেই। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার রাজনীতি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরোধী দলের কথা শোনার সুযোগ খুবই কম। এই চর্চা থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বেরিয়ে আসতে হবে। আগামী জাতীয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে এবং ইসির প্রতি আস্থা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিভাজন কাটাতে রাজনেতিক সমাধানে সফল সংলাপ প্রয়োজন। এদিকে জোর দিচ্ছে না কেউ। সবাই শর্ত দিয়ে সংলাপে বসতে চায়। শর্ত দিয়ে সংলাপ সফল হয় না।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় যতোই কমিয়ে আসছে, ততই উত্তপ্ত হচ্ছে দেশের রাজনীতি। সরকারবিরোধী আন্দোলনে মনযোগী মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। সারা দেশ থেকে নেতাকর্মী নিয়ে আগামী ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বড় ধরনের শোডাউন করতে চায় দলটি। তবে ২৮ অক্টোবর রাজধানী ঢাকা পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। ওইদিন জামায়েত বিএনপির নেতাকর্মীরা যেন কোনোভাবেই ঢাকা দখল করতে না পারে। সেজন্য ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে সবধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি থাকবে। আশপাশের জেলাগুলোতে আলাদা দৃষ্টি রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।মূলত আন্দোলনের নামে বিএনপি বড় ধরনের অঘটন ঘটাতে পারে এমন শঙ্কা থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। তবে অকারণে বিএনপির সঙ্গে বিশৃঙ্খলাতে না জড়ানোর নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে দলের হাই কমান্ড। তারপরও সংঘাত এড়ানো যাবে মনে হয় না। আগামী ২৮ অক্টোবর ঢাকায় কি হতে পারে এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানারকম আলাপ আলোচনা চলছে। নাগরিক জীবনে ইতিমধ্যে এক ধরনের উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় গোলযোগ হতে পারে, ভাঙচুর হতে পারে, নাশকতা হতে পারে এমন আশঙ্কায় নাগরিক জীবনে এক ধরনের ভীতি সঞ্চারিত হয়েছে। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে যে জনগণের জানমাল হেফাজতের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এবং সেটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী করবে।অন্যদিকে ক্ষমতাশীল আওয়ামী লীগ বলেছে বিএনপি যদি কোনোরকম সহিংসতা নাশকতা ইত্যাদি করতে চায় সেটি আওয়ামী লীগ প্রতিহত করবে। প্রশ্ন এসেছে যে বিএনপি কি করতে চায়? ২৮ অক্টোবরের ঘিরে বিএনপির পরিকল্পনা কি?
দ্বাদশ নির্বাচন এবং ২৮ অক্টোবরতে ঘিরে সরকারের ওপর ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে চায় বিএনপি। তাতে সক্ষমও হয়েছে কিছুটা। ২৮ অক্টোবরকে ঘিরে আমেরিকার রাষ্ট্রদুতকে আমরা এ বিসয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে যেতে দেখিছি। ২৮ অক্টোবরে সরকার বিরোধীদলে করর্মসূচিতে বাধা দিবে কিনা এমন প্রশ্নও করেছেন তিনি। বিএনপি নেতারা মনে করছেন যে, আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করলে সরকার একটি দুর্বল অবস্থায় পড়বে এবং এই দুর্বলতার কারণেই হয়তো শেষ পর্যন্ত সরকার পদত্যাগে বাধ্য হবে। বিএনপি আশা করছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার, গুম ইত্যাদি ইস্যুতে বড় ধরনের চাপ প্রয়োগ করবে এবং এই চাপ গুলো যদি শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে তাহলে সরকারের জন্য টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। তবে প্রধানমন্ত্রী এবং অপরাপর সরকার দলের নেতা এবং মন্ত্রীদের বক্তবে ডন্ট কেয়ার মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
উদ্বেগজনক একটি কথা বলেছেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদেরের। তিনি বলেছেন, নির্বাচন ঠিক সময়ে হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। কখন কি ঘটতে পারে তা নিয়ে শংক্র কথা বলা হয়েছে।ভিন্ন্ন ভেন্যু থেকে প্রায় অভিন্ন বার্তা দিচ্ছে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, হেফাজত, খেলাফত। নুরু-সাকী, রব-মান্না, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমতো নানা কথা বলছেনই। তাঁরা এগোচ্ছে অনেকটা যুগপতে।
তারা বলছেন- ‘সরকারকে চলে যেতে হবে’। তবে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের দিকে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন তথ্যের আলোকে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের বিশ্বাস, ড. ইউনূসই যত নষ্টের গোড়া। তিনিই পেছন থেকে যাবতীয় কলকাঠি নাড়ছেন। দমছেন না শ’দেড়েক মামলায় ফাঁসানোর পরও। বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় মার্কিনি চিকিৎসক আসার পেছনেও ড. ইউনূসের যোগসূত্র আঁচ করছে সরকার। অনেকে বলছেন আমেরিকা যা করছে তাতে ড. ইউনুসের হাত রয়েছে।
এ দিকে বিশ্ব কূটনীতিতে ভারতের নেতিয়ে পড়া ভরসার প্রশ্নে কিছুটা অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলেছে সরকারকে। এ সময়ে চীন-রাশিয়ার আগ বাড়িয়ে সরকারের পাশে থাকার ঘোষণাও আরেক অস্বস্তি। দেশ দুটিই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপের বেশি বেশি সমালোচনা করে সরকারকে চীন-রাশিয়া ঘেঁষার ‘সিল’ খাইয়ে বেকায়দা অবস্থায় ফেলছে। সেখান থেকে কায়দা করে সেফ পজিশন নেওয়ার রাস্তা সংকীর্ণ করে দিচ্ছে। করে দিচ্ছে কিছুটা বেসামালও। এর আগে কখনো এতটা কাবু হয়নি সরকার। বরং কোনো না কোনো অপশনে উতরে গেছে।বলার অপেক্ষা রাখে না, ছাই দিয়ে বা সাঁড়াশি দিয়ে বাংলাদেশকে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্র। অক্টোবরের মাঝামাঝি এই ধরাধরিতে যোগ দিয়েছে যুক্তরাজ্য-কানাডাসহ পশ্চিমা আরও কয়েকটি শক্তিধর রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের গণতন্ত্রের একটি রসায়ন চলমান বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশে রয়েছে প্রতিবেশী ভারতীয় গণতন্ত্রের কিছু মিশেলও। সেই ভারতেরই এখন বেগতিক দশা। ২০১৪ এবং ১৮-তে পরপর দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পেছনে ভারত এ সরকারকে একচেটিয়াভাবে ক্ষমতাসীন করেছে, ক্ষমতায় টিকিয়েও রেখেছে। সেই হিসেবে আগামীতে ভারত গেল দুবারের মতো না পারলেও যদ্দুর সম্ভব ভূমিকা রাখার আশাবাদ ছিল আওয়ামী লীগের। সেখানে এখন বিশাল ছন্দপতন। কূটনীতি করতে গিয়ে সাপ লুডু খেলার মতো খেলায় নেমেছিল ভারত। রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে পুরোনো স্নায়ুযুদ্ধের শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বর্তমান স্নায়ুযুদ্ধের সময় ঘনিষ্ঠ বন্ধু বানাতে গিয়ে ভুল চালের খেসারতে পড়েছে ভারত। কয়েক মাস পর দেশটির লোকসভার নির্বাচন। এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঝামেলা পেকেছে কানাডার সঙ্গে। তা এখন জটিল এবং বেশ নোংরা পর্যায়ে।
নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয় তাহলে কি হবে? আন্দোলনের ইস্যু তৈরি হবে, বাড়বে আশান্তি। অর্থনীতি ধ্বংস হবে। সম্পদ নষ্ট হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষের ক্ষয় হবে। দেশে বেকারত্ব বাড়বে, অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা দেখা দেবে। দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হবে। সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত হবে। এমনটা আমরা কেউই আর চাই না। তবে এটাও সত্য, বিরোধী দলের রাজনীতি করার পরিবেশ দিতে হবে বর্তমান সরকারকে। দেশের স্বার্থে তাদেরও ছাড় দিতে হবে।
কয়েক বছর আগে রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে আমরা প্রতিদিন যা দেখেছি, সে কথা এখনো ভুলে যাইনি। প্রতিনিয়ত চোখের সামনেই এসব ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছি। কিছুই করতে পারিনি। এসব রোধে আইন যে নেই, তা-ও নয়, আছে। নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা রাষ্ট্রের দ্বিতীয় অপরিহার্য কাজ। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ২৬-৪৭ক অনুচ্ছেদ পর্যন্ত নাগরিকের অধিকারগুলো বর্ণিত আছে। সেখানে কাউকেই নির্বিচারে মানুষ হত্যার বৈধতা দেওয়া হয়নি। এ হত্যার দায় যেমন বিরোধী দলের ছিল, রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে সরকারও এ দায় কিছুতেই এড়াতে পারে না। যখন হরতাল-অবরোধের নামে জীবন্ত মানুষ পুড়ে ঝলসে যায়, যখন তাদের উপার্জনের একমাত্র সম্বল কেড়ে নেওয়া হয়; অসহায় স্বজনের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়, যখন কষ্টার্জিত লাখ লাখ টাকার সম্পদ চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়, তখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনও প্রশ্নের মুখে পড়ে বৈকি!
আমরা বরাবরই যা দেখি, দেশপ্রেম, ধৈর্য, সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দেশের রাজনীতি থেকে উধাও। এ অবস্থায় বর্তমান রাজনীতিতে বেশি করে গণতন্ত্রচর্চা এবং দেশাত্মবোধ তৈরির জন্য আমাদের জোর দাবি তুলতে হবে এবং সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে দেশ দিন দিন আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে, যা জনগণ ও গণতন্ত্রের জন্য কখনোই কাম্য নয়। এ পরিস্থিতি আবার অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানকে সুযোগ করে দিতে পারে। আমরা আর অশান্তি চাই না, সংঘাত চাই না; আর জ্বালাও-পোড়াও চাই না। আমরা শান্তি চাই। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রের ভিত রচনা করেছিলেন। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি নির্বাচন। আগত নির্বাচন যেন সুষ্ঠু হয়, এই প্রত্যাশা সবার।
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন এলেই আমাদের রাজনীতির মাঠ গরম হয়। গরম কিছুটা হয়েছে। ২০২৪-এর শুরুতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। এ নির্বাচন ঘিরে আগেভাগেই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। শুরু হয়েছে বিক্ষেভ আর সভা-সমাবেশের রাজনীতি। বহু বছর ধরেই দেখছি ক্ষমতার পাঁচ বছরে শেষ বছরটা ভালোয় ভালোয় কাটে না। মারামারি, খুনোখুনি আর নানা হাঙ্গামায় উত্তপ্ত থাকে দেশ। কোনো প্রকার হাঙ্গামা না থাকলেও বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা আর হুংকারে আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা ভড়কে যাচ্ছি। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২২-এর ১০ ডিসেম্বর ঘিরে চরম উত্তেজনা ছিল দেশে। কি জানি কী হয়, এই ভয় ছিল জনমনে। কিছুই হয়নি। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হয়েছে। ২৮ অক্টোবরও হয়তো তাই হবে।
অন্যদিকে ব্যবসায়ীসহ অন্য একপক্ষ বলছেন, তারা দেশে আর জ্বালাও-পোড়াও হরতালের রাজনীতি চায় না, দেশ আর অশান্ত হোক চায় না। ডলার সংকটসহ নানান কারনে ব্যবসাবাণিজ্য ভালো যাচ্ছে না। হরতাল সংঘাত সংঘর্ষ হলে দেশ আরো পিছিয়ে যাবে। তারা দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। দেশের ব্যাপক উন্নয়নে এ ধরনের সংঘাতময় রাজনীতিকে তারা মোটেও পছন্দ করছেন না। দেশের মানুষ প্রকৃতই শান্তি চায়; রাজনৈতিক বিবাদ চায় না। এ জন্য সংলাপের বিকল্প নেই। টেবিলে বসে রাজনৈতিক সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসুক দেশ—এটাই কায়মনে চায় দেশবাসী।
তবে বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক সংঘাত বাড়ছে, তা এখন দৃশ্যমান। দেশ এবং জনস্বার্থে এ সংঘাত এড়াতেই হবে। দেশের ব্যাপক উন্নয়ন যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সে স্বার্থে দেশের আমজনতা সংঘাত চায় না। তা এড়ানো মোটেও হয়তো সম্ভব হচ্ছে না। আগত নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল ১৮০ ডিগ্রি বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও আন্দোলন সামনে রেখে মাঠে গড়িয়েছে রাজনীতি। রাজপথের কর্মসূচিকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত। নানা পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামছে ক্ষমতাসীনরা। সরকারি দলের নেতারা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচনের আগে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। তাই সংঘাতের দিকেই যাচ্ছে দেশ। নেতাদের মাঠ গরম করা বক্তৃতা-বিবৃতিতে কর্মীদের মধ্যেও নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এই প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করছে। দলীয় সংঘাত বাড়ছে। মিথ্যা মামলা গ্রেপ্তার বাড়ছে। এক দলের কর্মীরা আরেক দলের কর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। খুনখারাবি হচ্ছে। তা মহা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বস্তির একটা দিক আছে, অতীতে বিএনপি কিংবা বিরোধী দল সমাবেশের মোটেই অনুমতিই পেত না। এখন পাচ্ছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচক বলেই ধরে নিতে পারি আমরা। মন্দ দিকও আছে। বিএনপি যেখানেই সমাবেশ করেছে, সেখানেই কোনো একটা অজুহাতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকেরা আকস্মিক ধর্মঘট পালন করেছে। কখনো তারা নিরাপত্তার অজুহাত তুলেছেন, কখনো মহাসড়কে নছিমন-করিমন বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। এতে যে কেবল সমাবেশগামী মানুষই ভোগান্তিতে পড়েছে তা নয়, সাধারণ মানুষও সীমাহীন হয়রানির শিকার হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বন্ধ হওয়া জরুরি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে যে দাবি করা হচ্ছে দেশে সংঘাতময় পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে বিএনপিও সমমনা দলগুলো। প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজপথে এমনকি কথার সংঘাতে জড়িয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে রাজপথে ঠেকাতে ব্যাপক তৎপর আওয়ামী লীগ। বিএনপির তৎপরতা ঠেকাতে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। এসব দেশের জন্য অশান্তির বার্তা দেয় কি?
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজপথের অনিবার্য রক্তপাত এড়াতে কয়েকটি উপায় আছে। প্রথমত, বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে আগামী সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ করার বিষয়টি ফয়সালা করতে পারে চলতি সরকার। দ্বিতীয়ত, কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সরকার জাতীয় সংসদে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি বিল উত্থাপন ও পাস করে বিরোধীদলীয় আন্দোলন নিষ্প্রভ করে দিয়ে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করতে পারে। এটি করতে সরকারি দলের হয়তো কোনো অসুবিধা হবে না। তা না করলে হয়তো সংঘাতের দিকেই দেশ যেতে পারে।
যেকোনো দেশের রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করা গণতান্ত্রিক অধিকার। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের কর্মসূচি ও পরিকল্পনার কথা দেশবাসীকে জানাতে পারে। সেসব সমাবেশে সরাসরি কিংবা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বাধা সৃষ্টি শান্তিকামী মানুষকে উদ্বিগ্ন না করে পারে না। যেকোনো দলের রাজপথে ফয়সালা কিংবা রাজপথ দখল করার হুমকি-ধমকি কোনোভাবে কাম্য নয়। এমনিতেই দেশে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। বাজার অস্থির। মানুষের পণ্য কেনার ক্ষমতা কমছে। এ অবস্থায় বিএনপি কিংবা অন্য কোনো দলের অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করা মোটেও ঠিক হবে না। অন্যদিকে সরকারও যেন কোনোভাবে সংঘাতের পথে পা না বাড়ায়, তা দেশের জন্য মঙ্গলকর।
নির্বাচন আগত আর আমরা দেশবাসী চাই একটা সুষ্ঠু নির্বাচন। বিগত নির্বাচনগুলো একতরফা হলেও এবার মনে হচ্ছে তা হবে না। আবহাওয়াটা ফের গোমট ঠেকছে। বোধ করি আলোর দেখা মিলবে না। রাজনৈতিক যুদ্ধ আবারও হতে পারে। কেউ চায় না নির্বাচন কেন্দ্রে কোনো সংঘাত হোক, কোনো রক্তপাত হোক এবং কোনোরকমের প্রাণহানি হোক, ভোট লুটপাট হোক। এ ছাড়া প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনও জনগণ কামনা করে না। ভোটের অধিকার প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি নাগরিকের। সবাই যেন আনন্দচিত্তে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন সে নিশ্চয়তা নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালনকারীদের দিতে হবে। এবং নির্বাচনের পর রাজধানীতে যেন কোনোরূপ বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক দেশের শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই। আপামর জনগণের প্রত্যাশাও তাই। নির্বাচনের আগে ও পরে আপনাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটা ভালো ভূমিকা থাকতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, দলে দলে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়, এমন কাজ থেকে সবাইকে দূরে থাকতে হবে। প্রতিপক্ষকে রাজপথে মোকাবিলা কিংবা ফয়সালার পরিণাম; সে সঙ্গে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে দেশের অভ্যন্তরে কিংবা বহির্বিশ্বে সংঘাত তৈরি করার চেষ্টা কখনো মঙ্গলজনক হবে না। এ পথ থেকে সব দলকে এখনই বেরিয়ে আসতে হবে। যারাই জিতুক, শান্তিপূর্ণ ও অবিতর্কিত নির্বাচনের দৃষ্টান্ত স্থাপিত না হলে দলের জয় গণতন্ত্রের জয় বলে প্রতিষ্ঠিত হবে না। আমরা প্রত্যাশা করি কোনো জাতীয় রাজনীতির চাপে এই নির্বাচনের বৈশিষ্ট্যকে যেন প্রভাবিত করা না হয়। তাই সুষ্ঠু পরিবেশে ভোট দিতে পারা এবং স্বচ্ছভাবে ভোট গণনা ও ফলাফল প্রকাশ নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক :মহাসচিব- কলামিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ, চেয়ারপার্সন (পরিবেশ)- লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল (৩১৫ এ-১)।